ভারতের আগ্রায় অবস্থিত একটি রাজকীয় সমাধি হচ্ছে তাজমহল। এটি শুধুমাত্র একটি ভালোবাসার প্রতীক নয়। এটি সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে একটি বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তাজমহলের সৌন্দর্যতা সত্যিই মানুষকে অনেক মুগ্ধ করে থাকে।- Facts About Taj Mahal
বর্তমানে তাজমহল হচ্ছে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি। এই তাজমহল সম্পর্কে আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু ধারনা রয়েছে।
সৌন্দর্যের পাশাপাশি তাজমহলের জনপ্রিয়তার আরো একটি কারণ হলো এর ভালোবাসার ইতিহাস। বাদশা শাহজাহান তার বেগম মমতাজের সৃতিতে এর নির্মাণ করেছিলেন। শাহজাহান তাকে মমতাজ মহল উপাধি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ মহলের সবচেয়ে বহু মূল্য রত্ন। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ১৪তম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মমতাজের মৃত্যু হয়। সে সময় তিনি বুরহানপুড়ে ছিলেন।
সবচেয়ে প্রিয় বেগমের মৃত্যুতে বাদশা অত্যন্ত দুখী হয়ে পড়েন। তিনি এক সপ্তাহ নিজেকে গৃহবন্দী করে ফেলেন। না খেয়ে কেদে কেদে দিন কাটিয়েছিলেন। এর পরেই তিনি তাজমহল বানানোর কথা ঘোষনা করেন।
মৃত্যুর পর মমতাজকে বুরহানপুড়েই কবর দেয়া হয়েছিলো। এরপর তাজমহল বানানো শুরু করলে তাজমহলের পাশে থাকা একটি বাগিচায় মমতাজকে কবর দেয়া হয়। তাজমহল বানাতে ২২ বছর সময় লেগেছিলো। ততদিনে মমতাজের কবর বাগিচাতেই ছিলো। শেষ তাকে তাজমহলের ভেতর প্রধান গম্বুজের নিচেই কবরস্থ করা হয়।
এই তাজমহলের সৌন্দর্যের পিছনে এমন কিছু রহস্য লুকানো রয়েছে যা আমাদের মাঝে অজানা। তাই আমাদের আজকের পোস্টে তাজমহল তৈরির অজানা কিছু রহস্য উপস্থাপন করা হলো।
মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম যিনি মমতাজ নামে পরিচিত তারই স্মৃতিসৌধ হিসেবে সম্রাট এই সমাধী টি নির্মাণ করেন। তাজমহলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। এবং এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে।
এই তাজমহলের নকশাটি তৈরি করেন ওস্তাদ আহমেদ লাহুরী। এই নকশা অনুযায়ী তাজমহলের নির্মাণের গুরু দায়িত্ব পালন করেছিলেন জাহাঙ্গীরের সময়কার অভিজ্ঞ নির্মাণ শিল্পী মীর আব্দুল করিম।
জ্যোতিষীদের গণনায় সম্মতি না পাওয়ার ফলে প্রায় পাঁচ বছর সম্রাট শাহজাহান কে অপেক্ষা করতে হয়েছিল মমতাজকে বিয়ে করার জন্য। দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষা করার পর ১৬১২ সালে তাদের বিবাহ হয়।
মমতাজের মৃত্যুর পরেই শাহজাহান তার জন্য একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। আর সেটি হচ্ছে আজকের তাজমহল।
এই তাজমহল সৌন্দর্যের প্রধান কারণ হচ্ছে হিন্দু পারসিক শিল্পকলায় শ্বেত পাথরের উপর তৈরি করা সুন্দর সুন্দর ডিজাইন। এছাড়া দরজার উপরে অসাধারণ নকশা। এছাড়া এর সামনে রয়েছে সারি সারি ফুলের গাছ।
সর্বোপরি আমাদের এই পৃথিবী রহস্যের মায়াজালে বন্দী। ভারতবর্ষে এমন অনেক রহস্য রয়েছে যেটি তারা পুরো পৃথিবীর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চায়। এমন অনেক রহস্য রয়েছে যেগুলো মানুষের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনো এমন অনেক রহস্য রয়েছে যেগুলো সবার কাছ থেকে লুকানো হয়েছে।
এরকমই এক রহস্য রয়েছে তাজমহলের অভ্যন্তরে। একটি কথা সত্যই যে তাজমহলের নিচে হাজারের উপরে ঘর রয়েছে। সেই জামানায় যেসব সুরঙ্গ পথ তৈরি করা হতো সেখান থেকে বেরোনোর রাস্তাও বানানো হতো।
তাজমহলের নিচেও এরকম অনেক সুরঙ্গ পথ রয়েছে। তবে এইসব রাস্তা গুলি সম্রাট শাহজাহানের সময় থেকেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এমন কি কারন ছিল যে পথগুলি তৈরি করার পরেও বন্ধ রাখা হলো!
বিষয়গুলি আজও আমাদের কাছে অজানা। এই তাজমহলের একদম চূড়ার ওপর একটি গর্ত রয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন বিশাল এই রাজকীয় প্রাসাদের চূড়ায় এমন গর্ত রাখার কারণ কি!
এর পেছনে যে কারণটি ধারণা করা হয় সেটি হচ্ছে, তাজমহল তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর শাহজাহান সকল শ্রমিকের হাত কেটে নেয়ার আদেশ দেন।
তার উদ্দেশ্য ছিল তাজমহলের মত সুন্দর এক স্থাপত্য সারা বিশ্বে যেন আর কেউ বানাতে না পারে। আর এই আদেশ দেয়ার পরেই তাজমহলের শ্রমিকেরা তাজমহলের চূড়ায় একটি গর্ত করে দেন।
যার ফলে আজও বৃষ্টি হলে তাজমহলের চোরাই থেকে বৃষ্টি পড়ে। বলা হয়ে থাকে এরই কারণবশত তাজমহলের চূড়ায় অনেকবার বাশ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল।
তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাজমহল বাশ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিলো। যাতে যুদ্ধ বিমানের নজর থেকে এটিকে বাচানো যায়। ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ এ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ও তাজমহলের সুরক্ষার জন্য এটি করা হয়।
তবে তাজমহল বানানোর পর শ্রমিকদের হাত কাটা হয়েছিল কিনা এ বিষয়ে গুজব থাকলেও কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিষয়টি এখনো সবার কাছে অজানা। তবে কিছু ইতিহাসবিদদের ধারণা শাহজাহান তার শ্রমিকদের সারা জীবনের পারিশ্রমিক দিয়ে একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করিয়েছিলেন যে এমন মহল আর জীবনে তৈরি করবেন না।
আপনারা শুনলে হয়তো অবাক হবেন যে এই তাজমহলকে একবার বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। প্রচলিত কথা অনুযায়ী নটোবর নামে এক ব্যক্তি এই তাজমহল বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তবে এই ঘটনার পেতে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আমরা সকলেই জানি যে তাজমহলের চারদিকে চারটি মিনার রয়েছে। বাহ্যিকভাবে এই মিনার গুলিতে সুউচ্চ এবং সোজা বলেই মনে হয়। কিন্তু একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন চারটি মিনারই বাইরের দিকে সামান্য বাঁকা করে তৈরি করা হয়েছে। বাইরের দিকে তাকানোর কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মিনার গুলি ভেঙে পড়লেও যেন মূল ভবনের কোন ক্ষতি না হয়।
কুতুব মিনার ভারতের সবচেয়ে উচু মিনার। কিন্তু আপনি জানলে অবাক হবেন যে তাজমহলের উচ্চতা কুতুব মিনারের থেকেও বেশি। কুতুব মিনার ৭২.৫ মিটার উচু। আর তাজমহল ৭৩ মিটার উচু।
এই তাজমহলটি তৈরি করা হয়েছিল বহু নামিদামি মূল্যবান পাথর দিয়ে। যে পাথরগুলি আনা হয়েছিল চীন তিব্বত এবং শ্রীলংকা থেকে। এই তাজমহলের উপর যে পাথরগুলি বসানো হয়েছিল তা এখন পৃথিবীর অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
সারা বিশ্বে বর্তমানে তাজমহল ই একমাত্র নিদর্শন যাকে দেখার জন্য প্রতিনিয়ত হাজার হাজার পর্যটকের ভিড় জমে। প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ এখানে ভ্রমণ করতে আসেন।
আপনারা জানলে অবাক হবেন যে সম্রাট শাহজাহান আরও একটি কালো তাজমহল বানানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে মমতাজের স্মৃতির উদ্দেশ্যে যে সাদা তাজমহল তৈরি করেছেন ঠিক তারই পাশে তিনি নিজের জন্য একটি কালো তাজমহল তৈরি করবেন। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন তিনি পূরণ করতে পারেননি।
এর প্রধান কারণ ছিল পুত্র ঔরঙ্গজেব। শাহজাহান তার ছোট ছেলেকে রাজ্যের পরবর্তী রাজা বানাতে চেয়েছিলেন। আর এই কথা শোনার পর ঔরঙ্গজেব তার পিতা শাহজাহানকে বন্দী করে রাখেন। যেখান থেকে শাজাহান শুধুমাত্র ছোট্ট একটি জানালা দিয়েই ওই তাজমহলকে দেখতে পেতেন। তবে কালো তাজমহল তৈরির কোন ইতিহাস বা প্রমাণ কখনো পাওয়া যায় নি।
আর এভাবেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শাহজাহানকে কারারুদ্ধ অবস্থায় থাকতে হয়। যার কারণে তার স্বপ্ন অপূর্ন রয়ে যায়। মৃত্যুর পর তাকে মমতাজের পাশেই কবর দেয়া হয়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাজমহল কে নিয়ে বলেছিলেন, “সময়ের গালে এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু”।
শাহজাহান জানতেন এক সময় এই বিশাল অর্থ, সম্পদ, স্বৈরবল সবকিছু একদিন শেষ হয়ে যাবে। তিনি ভেবেছিলেন এমন কিছু তৈরি করবেন যা সারাজীবন থাকবে। এবং তিনি তার বেগমের সৃতিতে তাজমহল নির্মান করেন।
আজ বাদশা নেই, নেই তার বিশাল সাম্রাজ্য। আছে শুধু তাজমহল। যা ভালোবাসার ইতিহাস তার বুকে ধরে রেখেছে সযত্নে।
বলা হয়ে থাকে তাজমহলের সাথে সর্বপ্রথম সেলফি তুলেছিলেন জর্জ ক্যামেরুন। তিনি এই সেলফি টি তোলার জন্য ফি সাইলেন্স ব্যবহার করেছিলেন।
প্রচলিত কথা অনুযায়ী তাজমহলের রং দিনের সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। তাজমহলের রং সাদা হওয়ার ফলে সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে এর রংয়ের পরিবর্তন হয়ে থাকে।
ভোর বেলায় তাজমহলকে দেখলে হালকা গোলাপি বর্ণের মনে হয়। সূর্যাস্তের সময় এটি হালকা লাল বর্ণ ধারণ করে। আর পূর্ণিমার রাতে দেখলে এটি রূপালী বর্ণের মতো দেখায়।
আরো দেখুনঃ
চীনের প্রাচীর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য
কানাডা সম্পর্কে বিষ্ময়কর কিছু তথ্য -সবারই জানা প্রয়োজন
সিঙ্গাপুর সম্পর্কে বিষ্ময়কর কিছু তথ্য